* চার ধাপ এগিয়ে ঊর্ধ্বতনদের ডিঙিয়ে ১৩তম থেকে ৯ম গ্রেডে পদায়ন
* নজিরবিহীন এই পদায়ন সম্পর্কে জানেন না নতুন সচিব
* চেইন অব কমান্ড ভেঙে পড়ায় সারা দেশে খাদ্য বিভাগে অস্থিরতা
সরকারের অধস্তন কর্মচারীদের নজিরবিহীন এই পদায়নের ঘটনায় ক্ষুদ্ধ খাদ্য পরিদর্শকরা একযোগে আন্দোলন করাসহ আইনি লড়াইয়ে নেমেছেন। বর্তমানে ঊর্ধ্বতন পদ উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক হিসেবে চলতি দায়িত্ব পাওয়ার আগে ‘প্রধান সহকারী’ ও হিসাবরক্ষকরা ১৩তম গ্রেডে নিয়োগপ্রাপ্ত হয়েছিলেন। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আশীর্বাদপুষ্ট হয়ে তারা ৫ বছর ৭ মাসের মাথায় কয়েক ধাপ প্রমোশন নিয়ে দশম (১০ম) গ্রেডে অধিভুক্ত হন।
উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক পদটি মূলত নবম (৯ম) গ্রেডের। হিসেব অনুযায়ী খাদ্য পরিদর্শক’ পদে দশম (১০ম) গ্রেডে নিয়োগপ্রাপ্ত হয়ে যারা ইতোমধ্যে নবম (৯ম) গ্রেড পাচ্ছেন তারাই উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রকের শূন্যপদের বিপরীতে চলতি দায়িত্ব পাবেন।
কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে খাদ্য মন্ত্রণালয়ের লুটেরা ও সুবিধাভোগী সিন্ডিকেট তৎকালীন খাদ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. শাখাওয়াত হোসেনকে দিয়ে এই অনৈতিক সুপারিশ তৈরি করে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের পূর্বতন সচিব মো. ইসমাইল হোসেনকে কাজে লাগিয়ে পাস করিয়ে নেয়। এরই ধারাবাহিকতায় গত ২৩ সেপ্টেম্বর উপসচিব মো. আবুল আমিন স্বাক্ষরিত প্রজ্ঞাপনে ‘প্রধান সহকারী’ ও হিসাবরক্ষক পদের মোট ৬৯ জনকে শূন্যপদের বিপরীতে উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক পদের চলতি দায়িত্ব দেয়া হয়।
এদিকে আগের সচিব মো. ইসমাইল হোসেন বর্তমানে সমাজ কল্যাণ মন্ত্রণালয়ে ন্যস্ত। তিনি গত ১ অক্টোবর সমাজ কল্যাণ মন্ত্রণালয়ে সচিব পদে যোগদান করেন। তিনি গত ৮ জুন ২০২২ থেকে ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৪ তারিখ পর্যন্ত খাদ্য মন্ত্রণালয়ে সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। খাদ্য মন্ত্রণালয়ে নবনিযুক্ত সচিব মো. মাসুদুল হাসান বলেন, এ বিষয়টা সম্পর্কে আমি অবগত নই। অধস্তনদের সঙ্গে কথা বলে সবকিছু জেনে তবেই কিছু বলতে পারব।
অপরদিকে ২৩ সেপ্টেম্বর জারি হওয়া ওই প্রজ্ঞাপনের বিষয়ে প্রতিবাদ জানাতে সারা দেশের বিক্ষুব্ধ খাদ্য পরিদর্শকরা নিজ নিজ কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে গত ১ অক্টোবর খাদ্য ভবনে অবস্থান করে বিক্ষোভ করেন এবং ওই প্রজ্ঞাপন বাতিলের দাবি জানান। ইতোমধ্যে এ পদোন্নতিকে চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্ট, রাজশাহী, বগুড়া ও চট্টগ্রামের প্রশাসনিক ট্রাইব্যুনালে তিনটি পৃথক মামলা করেছেন পদোন্নতিবঞ্চিত ৯ ও ১০ গ্রেডের খাদ্য পরিদর্শকরা।
আন্দোলনরত খাদ্য পরিদর্শকদের একজন বলেন, আমরা অন্যায় আদেশ বাতিলে বৃহত্তর আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণা করতে যাচ্ছি। বৃহত্তর স্বার্থে আমরা এ নিয়ে নিজেদের সংগঠিত করছি। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের দীর্ঘ মেয়াদে খাদ্য অধিদপ্তর এবং খাদ্য মন্ত্রণালয়ের একটি চক্র নিয়োগ, বদলি ও পদোন্নতি বাণিজ্য করে বিপুল অঙ্কের অর্থ হাতিয়ে নিয়েছে।
অভিযোগের তির সমাজ কল্যাণ মন্ত্রণালয়ে বদলি হয়ে যাওয়া বিদায়ী খাদ্য সচিব মো. ইসমাইল হোসেনের দিকে। তিনি বদলি হওয়ার আগে এই অন্যায় আদেশ করে যান। এই পদোন্নতি বাস্তবায়নে মাঠপর্যায়ের ৬৯ জন কর্মচারীর কাছ থেকে প্রায় দেড় কোটি টাকা (মাথাপিছু ২ লাখ টাকা) সংগ্রহ করার অভিযোগ রয়েছে। এ টাকা সংগ্রহ করেছেন প্রধান সহকারী থেকে চলতি দায়িত্বের পদোন্নতিপ্রাপ্ত উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক মোহাম্মদ জাহিদুল ইসলাম ও মুকতাদির রহমান। জাহিদ ও মুকতাদির দুজনই ছাত্রলীগের ক্যাডার ছিলেন।
ঠাকুরগাঁও এর সাবেক সাংসদ ও খাদ্যমন্ত্রী রমেশ সেনের সহযোগী ও সাবেক জেলা ছাত্রলীগের সাবেক নেতা প্রধান সহকারী থেকে চলতি দায়িত্বে পদোন্নতি পাওয়া দিনাজপুরের বিরামপুর উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক মাসুদ রানার বিরুদ্ধে গেলো জুলাই আন্দোলনে ছাত্র হত্যার অভিযোগ আছে।
২০১০ সালে সাবেক খাদ্যমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাকের আমলে প্রশ্নপত্র জালিয়াতির মাধ্যমে এবং দলীয় প্রভাব বিস্তার করে উচ্চমান সহকারী পদে চাকরি পান তারা। রাজনৈতিক বিবেচনায় ১৪ বছর খাদ্য অধিদপ্তরে চাকরি করার সুবাদে দুজনই রাতারাতি কোটিপতি বনে যান।
অভিযোগ আছে, খাদ্য অধিদপ্তরের ২০১৪, ২০২০ ও ২০২২ সালের কর্মচারী নিয়োগে প্রশ্নপত্র ফাঁস ও উত্তরপত্র জালিয়াতির মাধ্যমে বিদায়ী খাদ্য সচিব মো. ইসমাইল হোসেন ও ক্ষমতাচ্যুত সরকারের খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদারের আশীর্বাদে তারা আঙুল ফুলে কলাগাছ হয়ে ওঠেন। নিয়োগের পাশাপাশি মাঠপর্যায়ে পিয়ন থেকে শুরু করে খাদ্য পরিদর্শক, উপজেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক, জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রকের বদলি-বাণিজ্য, খাদ্য ভবনের বিভিন্ন দরপত্র নিয়ন্ত্রণ, সারা দেশের চালকল খাদ্য অধিদপ্তরের তালিকাভুক্তকরণ, সড়ক-নৌ-রেল পরিবহনের মাধ্যমে খাদ্য সরবরাহ ব্যবস্থায় মন্ত্রী ও সচিবের হয়ে কাজ করেন তারা।
সারাদেশের বিক্ষুব্দ খাদ্য পরিদর্শকেরা নিজ নিজ কর্তৃপক্ষের অনুমতি নিয়ে ১ অক্টোবর খাদ্য ভবনে অবস্থান করে প্রতিবাদ জানান। খাদ্য পরিদর্শকের আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে দুর্নীতিবাজ খাদ্য সচিব মো. ইসমাইল হোসেনকে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ে বদলী করলেও এ অন্যায় আদেশের সাথে জড়িত অন্যরা ধরাছোঁয়ার বাহিরে রয়ে গেছে। এসব অভিযোগের ব্যাপারে বক্তব্য জানতে বর্তমানে সমাজ কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত সচিব মো. ইসমাইল হোসেনের দাপ্তরিক ফোন নাম্বারে কল দিয়ে বারবার চেষ্টা করা হলে তিনি কোনো সাড়া দেন নি।
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব (প্রশাসন-১ অধিশাখা) এ কে এম মামুনুর রশিদ বলেন, পদায়ন বা চলতি দায়িত্ব প্রদানের ক্ষেত্রে খাদ্য অধিদপ্তরের একটি নীতিমালা রয়েছে। সে অনুযায়ীই চলতি দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। ওই নীতিমালায় ‘খাদ্য পরিদর্শক’ এবং প্রধান সহকারী ও হিসাবরক্ষক’দের মধ্যে কারা কী পরিমাণ পাবেন তার কোটা বরাদ্দ রয়েছে। আর এটি করা হয়েছে আগের মহাপরিচালক মো. শাখাওয়াত হোসেনের রেখে যাওয়া সুপারিশের ভিত্তিতে। সুপারিশটি তৈরি করা হয় মাস ছয়েক আগে। তিনি জানান, পূর্বতন ডিজি মো. শাখাওয়াত হোসেন এখন নেই। তিনি পিআরএল (অবসরপূর্ব ছুটি) ভোগ করছেন। তিনি ২৭ জানুয়ারি ২০২২ থেকে ১৩ আগস্ট ২০২৪ মেয়াদে দায়িত্বে ছিলেন। বর্তমান ডিজি মো. আব্দুল খালেক যোগ দেন ১০ সেপ্টেম্বর। নতুন এই ডিজির সময়ে গত ২৩ সেপ্টেম্বর আলোচিত এ প্রজ্ঞাপন জারি হয়।
নিউজটি আপডেট করেছেন : Dainik Janata

খাদ্য পরিদর্শকদের মধ্যে অসন্তোষ
- আপলোড সময় : ২০-১০-২০২৪ ১২:১৪:১৬ পূর্বাহ্ন
- আপডেট সময় : ২০-১০-২০২৪ ১২:১৪:১৬ পূর্বাহ্ন


কমেন্ট বক্স
সর্বশেষ সংবাদ